প্রায় তিন মাস ধরে ইয়াংগুন থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রফতানি বন্ধ রেখেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। আরাকান আর্মির প্রতিবন্ধকতার কারণে এ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে গত বছরের তুলনায় ২৪৭ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। তবে দেশটির বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত রাখাইন রাজ্যের মংডু’র সঙ্গে স্থলবন্দরে ছোট পরিসরে চালু রয়েছে আমদানি-রফতানি। এর ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে রাখাইন রাজ্য থেকে ৩০ বস্তার একটি শুঁটকির ট্রলার টেকনাফ স্থলবন্দরে পৌঁছেছে।
এ তথ্য নিশ্চিত করে টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্টের ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ আনোয়ার বলেন, ‘আজকে আরাকান আর্মির দখলে থাকা রাখাইন রাজ্যে থেকে শুঁটকিবাহী একটি ট্রলার এসেছে, সেটি খালাস চলছে।’তিনি বলেন, ‘এরআগে গত ১৬ জানুয়ারিতে মিয়ানমারের ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্যবাহী ট্রলার আসার পথে নাফনদে ট্রলারগুলো আটকে রাখে আরাকান আর্মি। এর কিছুদিন পর ট্রলারগুলো ফের ছেড়ে দেয়। তখন থেকে ভরসা না পাওয়ায় (১০ এপ্রিল পর্যন্ত) ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরের উদ্দেশে কোনও পণ্যবাহী ট্রলার ছাড়েনি জান্তা সরকার। কিন্তু মংডু’র সাথে স্থলবন্দরে স্বল্প পরিসরে আমদানি-রফতানি চলমান রয়েছে। সব মিলিয়ে স্থলবন্দরের অবস্থা খুব মন্দা।’
এদিকে মিয়ানমারে বছরখানেক ধরেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত দখলে নেয় দেশটির বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এর ধারাবাহিকতায় গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে হামলা চালিয়ে রাখাইন রাজ্যের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৪টির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে সে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপসহ সীমান্তের অধিকাংশ এলাকায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছিল। রাখাইনে বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে অনেকটাই কোণঠাসা মিয়ানমারের সেনা ও নৌবাহিনী। এর পর থেকে নাফ নদীতে তাদের জলসীমায় নৌযান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
বন্দর শ্রমিকরা জানান, রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মির কারণে ইয়াংগুন থেকে কোনও পণ্যবাহী ট্রলার আসছে না। বন্দর অনেকটা অচল রয়েছে। ফলে বেকার সময় পার করতে হচ্ছে তাদের। জানতে চাইলে টেকনাফ স্থলবন্দরের শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ বছর ধরে স্থলবন্দরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছি। এমন অবস্থা খারাপ অবস্থা হয়নি। কিন্তু সে দেশে যুদ্ধ শুরুর পর গত আট-নয় মাস ধরে বন্দরে খুব কম পণ্য আসছে। যার কারণে শ্রমিকদের আয় বন্ধ হওয়ার পথে। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে আমাদের। আমাদের একটা চাওয়া মিয়ানমারের দুই পক্ষের সাথে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করে যাতে আগের মতো পণ্য আমদানি-রফতানি চালু করা হয়।’
বন্দরের কাস্টম কর্মকর্তারা জানায়, গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৯৫৭ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে সরকার ১০৮ কোটি ২৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ৩১২ টাকা রাজস্ব পায়। গেলো অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) জুলাই থেকে ২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫৯ হাজার ৯৬৮ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়। যার ফলে সরকার ৩৫৬ কোটি ৫১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৭২৩ টাকা রাজস্ব পায়। রাখাইনে যুদ্ধের প্রভাবে গত বছরের তুলনায় ২৪৭ কোটি ২৭ লক্ষ ৬৮ হাজার ৪১১ টাকার রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। অন্যদিকে গত দুই অর্থ বছরে যেসব পণ্য রফতানি হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— সিমেন্ট, আলু ও প্লাস্টিক প্রোডাক্ট। ইয়াংগুনের সাথে টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকলেও চালু রয়েছে মংডুর সাথে। গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৯ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা দামের ৭ হাজার ১১৭ টন বিভিন্ন পণ্য রফতানি হয়েছে। গেলো অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) জুলাই থেকে ২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত পওয়া ২ দশমিক ৪১ কোটি টাকা দামের ৬৯১ মেট্রিক টন পণ্য রফতানি হয়।
স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ‘আরাকান আর্মি বন্দরে আসার পথে পণ্যবাহী জাহাজ আটকের পর ইয়াংগুন থেকে পণ্যবাহী জাহাজ আসা বন্ধ রয়েছে। মূলত ট্রলার আটকানোর দায়ে জান্তা সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়ছে, পাশাপাশি শ্রমিকের কষ্ট বাড়ছে। এছাড়া সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব সমাধানে মিয়ানমারের দুই পক্ষের সাথে আরও ভালো সম্পর্ক গড়তে হবে।’
এ বিষয়ে টেকনাফ স্থলবন্দর রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সোহেল উদ্দিন বলেন, ‘আরাকান আর্মি সীমান্ত দখলের পর প্রায় তিন মাস ধরে ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। যার কারণে রাজস্ব ধস নেমেছে। তবে রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি-রফতানি চলমান রয়েছে।’ কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘মূলত আরাকান আর্মির কারণে আমাদের সীমান্ত বাণিজ্যে বড় প্রভাব পড়ছে। তাই বাংলাদেশের উচিত আরাকান আর্মির সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক বাড়ানো। অন্যথায় সীমান্তের ব্যবসায়ীরা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।’
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন